বাংলা স্কুপ, ৯ অক্টোবর:
পর্যটন এলাকা কলাপাড়া ও কুয়াকাটায় অন্তত ২০ হাজার একর কৃষিজমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এসব জমির অন্তত এক তৃতীয়াংশ এখন স্থায়ীভাবে পতিত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র পায়রা বন্দর, তিনটি বিদ্যুৎপ্লান্টসহ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে দশ হাজার একর কৃষিজমি কমে গেছে। এ কারণে এখানে প্রতিবছর অন্তত ৪২ হাজার মেট্রিক টন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে গেছে। ক্রমশ অনাবাদী জমির পরিমাণ বাড়ছে। এছাড়া কয়েক কোটি টাকার রবিশস্যসহ শাকসবজির আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। কুয়াকাটা ও ধানখালীতে প্রতিবছর শত কোটি টাকার তরমুজের আবাদ হতো। যা এখন হয় না বললেই চলে। আবাসন আগ্রাসনে সাগরপারে কৃষিক্ষেত্রে মানুষসৃষ্ট এমন বিপর্যয় ক্রমাগত বেড়েই চলছে। এখানকার পর্যটন এলাকা কুয়াকাটাসহ ধানখালীতে অধিকাংশ কৃষিজমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। লতাচাপলী ইউনিয়নের খাজুরা থেকে পর্যটনপল্লী গঙ্গামতি এবং কাউয়ারচর পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকায় এমন চিত্র বিদ্যমান। এখানে কৃষিকাজে ব্যবহারের অন্তত পাঁচ হাজার একর জমি পতিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে দ্বিগুণ উদ্বৃত্তের কলাপাড়া এখন খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা হয়েছে। মালিকানা পাল্টে গেছে কৃষিজমির।
জমির মালিকানা বদল প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রায় ২০ বছর আগে বছর আগে। কিন্তু এসব জমিতে এখন পর্যন্ত কোন ধরনের স্থাপনা তোলা হয়নি। ধানখালীতে বিদ্যুতপ্লান্ট ও টিয়াখালী-লালুয়ায় পায়রা বন্দর-নৌঘাটি করা হয়েছে। তবে কুয়াকাটা পৌর এলাকাসহ আশেপাশের জমির চারদিকে দেয়াল কিংবা পিলার দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ওইসব জমিতে হালচাষ। ধানসহ কৃষি উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এসব এলাকার কৃষকসহ হাইলা-কামলা এবং কৃষি শ্রমিকরা হারিয়েছে তাদের কর্মক্ষেত্র। এসব এলাকার মানুষ ১৫/১৬ বছর আগে তাদের উৎপাদিত ধানসহ রবিশস্য নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফলন এলাকার বাইরে বিক্রি করত। অথচ বর্তমানে নিজেদের বছরের খোরাকি চাল পর্যন্ত এলাকার বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীর জন্য এলাকার বাইরের হাট-বাজার কিংবা মোকামের দ্বারস্থ হতে হয়। মোট কথা কৃষিনির্ভর এই এলাকায় এখন কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে চাষাবাদ হচ্ছে এমন জমির মধ্যেও বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির অসংখ্য সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে। কলাপাড়া উপজেলার ২০১১ সালের ল্যান্ডজোনিং রিপোর্ট অনুসারে উপজেলার লতাচাপলী এবং ধুলাসার ইউনিয়নে মোট জমির পরিমাণ ২৫ হাজার দুই ’শ ৭৩ একর। এর মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ ১৩ হাজার চার ’শ ৪১ একর। বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার অবস্থান লতাচাপলী ইউনিয়নে এবং পর্যটনপল্লী গঙ্গামতির অবস্থান ধুলাসার ইউনিয়নে।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, লতাচাপলী ইউনিয়নের পশ্চিম খাজুরা গ্রাম থেকে গত ১৫ বছরে অন্তত ৫০টি কৃষক ও জেলে পরিবার এখান থেকে বাড়িঘরসহ চাষের জমি বিক্রি করে চলে গেছে অন্যত্র। শুধু পশ্চিম খাজুরা নয়। একই দৃশ্য মাঝিবাড়ি, মিরাবাড়ি, পশ্চিম কুয়াকাটা, কুয়াকাটা, কেরানিপাড়া, নবীনপুর, শরীফপুর, মম্বিপাড়া, হুইচেনপাড়া, বড়হরপাড়া, মম্বিপাড়া, গঙ্গামতি, ধুলাসার, নতুনপাড়া, কাউয়ারচর, বটতলাসহ সর্বত্র। হাজার হাজার একর জমিতে এখন দাড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইনবোর্ড। এক যুগ আগের দেখা মানুষের কাছে এই দীর্ঘ এলাকা এখন অপরিচিত মনে হয়। যেন স্থায়ীভাবে অনাবাদী হয়ে পড়ছে মাইলের পর মাইল কৃষি জমি। মানুষের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই দৃশ্য টিয়াখালী, ধানখালী ও লালুয়ায়। যেভাবে কৃষি জমি দ্রুত অনাবাদী হচ্ছে তাতে সাগরপারের কৃষি জনপদ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে সেখানে কী পরিমাণ কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। খাজুরা বাঁধের স্লোপে ছোট্ট দোকানি মোঃ ফরহাদ হোসেন। বয়স প্রায় ৬০ বছর। প্রায় দেড়যুগ ছোট্ট ব্যবসার পাশাপাশি গবাদিপশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। এখন চাষাবাদ করে সবজি রবিশস্য আবাদের জমি তার নেই। এখন গোটা এলাকার কৃষিজমি দেখলে মনে হয় যেন বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। অথচ ১৫-২০ বছর আগেও এই বিশাল এলাকাজুড়ে ধানের পাশাপাশি তরমুজ, ডাল জাতীয় ফসলের বাম্পার ফলন হতো। জানা গেছে, ইয়েস বাংলা ছাড়াও ইউনিক কোম্পানির প্রায় ১০ একর, সাগর নীড় প্রকল্পের বিরাট এলাকা দেড়যুগ ধরে অনাবাদি পড়ে আছে। ওই এলাকা থেকে ইতোমধ্যে ওয়াজেদ খান, শামসুল হক, মুনসের, ফজু হাওলাদার, মোসলেম আলী, কালামসহ বহু কৃষক তাদের জমিজমা বিক্রি করে পাশের তালতলীসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। যারা রয়েছেন তারাও ভরাটের কারণে চাষাবাদ করতে পারছেন না। সুলতান ও এমাদুল জানালেন, তারা নিজেরাই কত বছর ধরে তরমুজের আবাদ করতে পারেননি। নিরাপদ পানির সঙ্কট চলছে। দূরের কোন গভীর নলকুপ একমাত্র ভরসা।
চাষাবাদ তো দূরের কথা, এখন হাজার হাজার শ্রমজীবি ও কৃষক পরিবারের বসবাসে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। দেবপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক ফরিদ উদ্দিন জানান, আমাদের জমিজমা অধিগ্রহণের নামে চালানো হয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পুলিশসহ মাস্তান ভাড়া করে বাড়িঘর থেকে নামানো হয়েছে। জমির ক্ষতিপূরণ তো মেলেইনি, ঘরবাড়ির টাকা পর্যন্ত পায়নি এসব মানুষ। ২৮০টি কৃষক-জেলে পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের ৯৭৫ একর জমিতে এখন বালু ভরাট হচ্ছে। কুয়াকাটার স্থানীয়রা জানান, হাজার হাজার একর কৃষিজমি হাউজিং কোম্পানি কিনে বাউন্ডারি করে ফেলে রেখেছে বছরের পর বছর। এভাবে খাজুরা থেকে চরকাউয়া এবং গঙ্গামতি পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় কৃষি জমিতে এখন শত শত সাইনবোর্ড দাড়িয়ে আছে। এসব এলাকার শ্রমজীবি হাইলা-কামলা শ্রেণীর হাজার হাজার পরিবারও রয়েছে আবাসস্থল হারিয়েছে। অধিকাংশ জমি পড়ে আছে পতিত অবস্থায়।
২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর ভূমি মন্তণালয়ের তৎকালীন সচিব মো. মোখলেসুর রহমান কলাপাড়ায় ল্যান্ডজোনিং বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় স্পষ্ট করে বলেছিলেন, কুয়াকাটায় হাউজিং কোম্পানির ব্যবসায় কোন ধরনের অনুমতি সরকারিভাবে দেয়া হয়নি। এছাড়া ভূমি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনে বলা আছে কৃষিজমি কোন কৃষক ছাড়া হস্তান্তর করার সুযোগ নেই। আর কৃষিজমিতে আবাসন ব্যবসার কোন সুযোগও নেই। তারপরও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা পর্যটন এলাকাসহ সর্বত্র কৃষিজমি কিনে ভরাট করা হয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সবুজের আস্তরণে ঢেকে থাকা সাগরপারের জনপদ পরিণত হতে যাচ্ছে যেন বিরানভূমিতে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, সরকারিভাবে কলাপাড়ায় অন্তত আট হাজার হেক্টর কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে হেক্টর প্রতি অন্তত ৪ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হতো। তবে এখন জমি কমলেও কৃষকরা উন্নত জাতের ধানের আবাদ করে ফলন বাড়িয়েছে। এব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে কৃষি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।
মেজবাহউদ্দিন মাননু/এসকে